প্রতিবেদক আলমগীর হোসেন তালুকদার
সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘মন্ত্রী হয়ে আমার লোকসান হয়েছে। আমার আয় কমে গেছে। আগে আদালতে গিয়ে আইনজীবী হিসেবে পেশাগত কাজ করতে পারলেও এখন সেটা করতে পারি না। তাই আয় কমেছে।’
আনিসুল হকের হলফানামা ঘেঁটে এর সত্যতা পাওয়া যায়। তবে আয় কমলেও তার স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তি অনেক বেড়েছে। তিনি দু’টি ব্যাংকের মালিকানায় নাম লেখান। সিটিজেনস ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংকে তার বিনিয়োগের পরিমান প্রায় ৪০ কোটি টাকা বলে হলফনামায় উল্লেখ করেন।
যদিও স্থানীয় একাধিক সূত্রের দাবি, সিটিজেনস ব্যাংকটির মালিক মূলত আনিসুল হক। ওনার মা বীরমুক্তিযোদ্ধা জাহানারা হকের নামেই ব্যাংকের অনুমোদন করানো হয়। মায়ের মৃত্যুর পর তৌফিকা আফতাব নামে এক সহকর্মীকে তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বানান। এছাড়া একটি বেসরকারি টেলিভিশনের মালিকানা কিনে সেখানেও বসিয়ে দেন তৌফিকা আফতাবকে।
বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর আনিসুল হক এখন জেলহাজতে আছেন। তৌফিকা আফতাব ইতিমধ্যেই কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন বলে আলোচনা আছে। ওই দু’জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে আনিসুল হককে কেন্দ্র করে স্থানীয় অনেক নেতা-কর্মীও ফুলেফেঁপে উঠেন। মূলত নিয়োগ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে কেউ কেউ শত কোটি টাকার মালিকও বনে যান। আনিসুল হকের সাবেক পিএস রাশেদুল কায়সার ভুইয়া জীবন, মন্ত্রীর খুবই ঘনিষ্টজন আখাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক মো. তাকজিল খলিফা কাজল ও তার ভাই ফোরকান আহমেদ খলিফা, আখাউড়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. মুরাদ হোসেন, আনিসুল হকে পিএ মো. আলাউদ্দিন বাবু, শফিকুল ইসলাম সোহাগ চাকরি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। আদালতের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া ও সাবরেজিস্ট্রার বদলি থেকে ওই সিন্ডিকেট টাকা হাতিয়ে নিতেন। আইনমন্ত্রণালয়ে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তাও এসব নিয়োগের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এপিএস থেকে চলে এসে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে অনেক বিষয়েই রাশেদুল কায়সারের কর্তৃত্ব কমতে থাকে। আনিসুল হকের পিএ আলাউদ্দিন বাবুই ছিলেন চাকরি, বদলি বিষয়ে নিয়ন্ত্রক। সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আলাউদ্দিন বাবুর প্ররোচণায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন আনিসুল হকের ফুফাতো ভাই ছাইদুর রহমান স্বপন। এরপর থেকে মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগই বন্ধ করে দেন রাশেদুল কায়সার।
এদিকে আলাউদ্দিন বাবু সরকারের পট পরিবর্তনের পর থেকে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লেখালেখিতেও বাবু এমনই বুঝানোর চেষ্টা করছেন। বাবুর বাবা ইদ্রিস মিয়া ইতিমধ্যেই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ইদ্রিস মিয়ার সাবেক আইনমন্ত্রীর কসবার পানিয়ারূপের গ্রামের বাড়ি দেখভাল করতে বলে বেশ বিশ্বস্ত ছিলেন। তবে ইদ্রিস ও তার মেয়ে জামাই আমজাদ হোসেনও বিভিন্ন সময়ে আনিসুল হককে পুঁজি করে আর্থিক ফায়দা লুটতেন বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন।
আনিসুল হক কসবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ২০১৪ সালে তিনি প্রথমবারের এই আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন। এরপর ২০১৮ তেও প্রার্থী হয়ে দ্বিতীয় বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আইনমন্ত্রী এবারের হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছেন এলএলএম পাস। গত দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেছিলেন এলএলবি। এবারের ভোটে দাঁড়ানোর সময় দেওয়ায় হলফনামায় পেশা হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘সিনিয়র আইনজীবী ও বর্তমানে মন্ত্রী’।
হলফনামা ঘেঁটে দেখা যায়, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ি (ডিসেম্বর ২০২৩ নাগাদ) আইনমন্ত্রীর বার্ষিক আয় এক কোটি পাঁচ লাখ ৯৫ হাজার ৫২৭ টাকা, যা ২০১৮ সালে ছিল আট কোটি ছয় লাখ ২১২ হাজার ৬৫২ টাকা এবং ২০১৪ সালে ছিল পাঁচ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। সর্বশেষ তিনি বাড়ি ভাড়া থেকে পাঁচ লাখ ২৪ হাজার ৫৭৯ টাকা, ব্যাংকে মায়ের নামের সঞ্চয়পত্র থেকে এক লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকা, পেশা থেকে প্রায় ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা এবং ব্যাংকের মুনাফা বাবদ ৪৩ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮৪ টাকা আয় করতেন। এছাড়া তিনি কৃষি ও মৎস্য খাত থেকে বছরে ৪৩ লাখ টাকা আয় করেন।
বর্তমানে আইমন্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ ৬৮ কোটি ৮৫ লাখ ৯৯ হাজার ৮৮৪ টাকার এবং ২০ ভরি সোনা ও প্রায় এক হাজার ৪০০ ইউএস ডলার, যা ২০১৪ সালে ছিল চার কোটি ৬০ লাখ টাকার ও ১৩ হাজার ইউএস ডলার। ২০১৮ সালে ছিল ২৪ হাজার ৭৭৯ ইউএস ডলার ও ২০ ভরি স্বর্ণসহ প্রায় পাঁচ কোটি ৯১ লাখ ৮২ হাজার ৯৯২ টাকার। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে তার অস্থাবর সম্পত্তি বাড়ে ১৩ গুণ।
বর্তমানে সিটিজেন ব্যাংক ও এক্সিম বাংলাদেশে তাঁর বিনিয়োগ ৪০ কোটি ১০ লাখ টাকা, যা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ছিল না। আনিসুল হকের বর্তমানে একটি পিস্তল রয়েছে, যা আগে ছিল না। আনিসুল হকের কাছে নগদ আছে ১০ কোটি ৯২ লাখ ৯৪ হাজার ১৯৯ টাকা, যা ২০১৮ সালে ছিল ছয় লাখ ও ২০১৪ সালে ছিল পাঁচ লাখ। ১০ বছরের ব্যবধানে লাখ থেকে কোটিপতির খাতায় নাম লেখান। ওই সময়ে তার নগদ অর্থ বাড়ে ২০০ গুণের বেশি।
পাঁচ বছর সময়ের মধ্যে মা ও একমাত্র বোনকে হারানো আনিসুল হকের স্থাবর সম্পদও বেড়েছে। এখন তাঁর স্থাবর সম্পদ রয়েছে তিন কোটি ৪৮ লাখ ১৯ হাজার ৮৫৮ টাকার, যা ২০১৮ সালে ছিল ৯০ লাখ টাকা ৩৮ হাজার ৪৪৫ টাকার ও পৈত্রিকভাবে পাওয়া তিনটি মৎস্য খামার এবং ২০১৪ সালে তিন কোটি ৯১ লাখ টাকার। এছাড়া যৌথ মালিকানায় পৈত্রিকভাবে তিনি ৪৮ বিঘা জমি ও একটি বাড়ি মালিক, যা ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও ছিলো। তাঁর কোনো ঋণ নেই।
আনিসুল হক ওই সময়ে হলফানামার তথ্য বিষয়ে জানিয়েছিলেন, মায়ের মৃত্যুর পর পৈতৃকভাবে অনেক কিছু পাওয়ায় তার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বেড়ে যায়। পৈতৃকভাবে পাওয়া সম্পত্তিসহ নিজের বৈধ আয়ে যা যা করেছেন এর সবকিছু তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।
প্রকাশক : নাদিম হোসেন তালুকদার, প্রধান সম্পাদক: আলমগীর হোসেন তালুকদার, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : মোহনা চৌধুরী পিয়া, উপদেষ্টা: মোস্তফা সরোয়ার, আইন উপদেষ্টা :অ্যাডভোকেট তোহা, নির্বাহীসম্পাদক: মোহাম্মদ হবে হাফেজ মাওলানা আব্দুর রহমান, ফোন নাম্বার : 𝟎𝟏𝟕𝟏𝟏𝟒𝟑𝟏𝟏𝟔𝟑, প্রধান কার্যালয় : ৩ নং চিড়িয়াখানা রোড, নিউ সি ব্লক, মিরপুর-১ ঢাকা ১২১৬
E-mail : dainikbbckhobor.com@gmail.com
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত