বাদল আহাম্মদ খান নিজস্ব প্রতিবেদক
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার শ্রী শ্রী লোকনাথ সেবাশ্রম শান্তিবন মহাশ্মশাণের জায়গা দখলের ঘটনায় জড়িত তিন ভাইয়ের মধ্যে প্রবাসী আল-নাসির ছিলেন আওয়ামী লীগের পৃষ্টপোষক। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের কয়েকমাস আগে এলাকায় এসে তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। একই সঙ্গে তিনি দলীয় নানা আয়োজনে অর্থ ব্যয় করেন।
একাধিক সূত্র জানায়, দলীয় কর্মসূচির প্যান্ডেল তৈরি, খাবার আয়োজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন আয়োজনে তিনি টাকা দিয়ে সহায়তা করতেন। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতাকেও নিয়মিত অর্থ দিতেন। ওই নেতা তখনই এ বিষয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বসে আলোচনা করে সমাধানের জন্য আলোচনা করতে থাকেন। তবে শ্মশাণ কর্তৃপক্ষ এতে রাজি হননি। আল-নাসির ও তার ভাইয়েরা এখন আরেকটি প্রভাবশালী পক্ষকে ম্যানেজ করেছেন। দু’চারজন সাংবাদিককে ডেকে তারা মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেছেন।
তবে দখলকারিদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন উপজেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ। একইসঙ্গে তারা বলেছেন, ‘শেষকৃত্যের এই জায়গা যে অন্যায়ভাবে দখলে নিবে সে নিজেই পুড়ে মরবে। ধ্বংস হয়ে যাবে। সৃষ্টিকর্তা তাকেও ছাড় দিবে না। কোনোভাবেই শ্মশাণের একটুকরো জায়গা দখল করতে দেওয়া হবে না।’ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের লোকজনও শ্মশাণ দখলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার রাতে আখাউড়া উপজেলার নেতৃস্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে আলোচনাকালে বিএনপি নেতারা এ বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধানের আশ^াস দেন। শ্রী শ্রী রাধামাধব আখড়া কেন্দ্রীয় মন্দিরে এ সভায় জানানো হয়, জায়গা দখলের নেপথ্যে থাকা তিন ভাইয়ের একজন আল নাসির মূলত আওয়ামী লীগের অর্থের জোগানদাতা ছিলেন। দলীয় আয়োজনে তিনি বড় অঙ্কের টাকা দিতেন। এখন একটি প্রভাবশালী চক্রকে তিনি ম্যানেজ করে এ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের দলের কেউ যদি এটার সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে তথ্য দিতে। সত্যতা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি সমাধানে দখলকারিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে খুব দ্রুতই আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা হবে।
লোকনাথ সেবাশ্রমের উপদেষ্টা রঞ্জিত দাসের সভাপতিত্বে রাধামাধব আখড়ার ভোজনালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন, উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি জয়নাল আবেদীন আব্দু, সাধারন সম্পাদক ডা. খোরশেদ আলম ভূঁইয়া, মো. হারুনূর রশিদ, মো. সেলিম ভূঁইয়া, মো. আক্তার হোসেন, চন্দন কুমার ঘোষ, অলক কুমার চক্রবর্তী, আশীষ ব্রহ্মচারি প্রমুখ।
এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার সকালে ২৪টি মন্দির কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসে পুজা উদযাপন পরিষদ। নাট মন্দিরে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিষদের আহবায়ক দীপক কুমার ঘোষ। সদস্য সচিব বিশ^জিৎ পাল বাবু’র সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন, চন্দন কুমার ঘোষ, আশীষ ব্রহ্মচারি, তাপস দাস, সুভাস দাস, আশীষ সাহা, রুপক বনিক, নসিব হরিজন প্রমুখ।
এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার সকালে সড়ক বাজার এলাকায় হওয়া হাজারো মানুষের মানববন্ধন থেকে সাতদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, ২৯ আগস্ট আখাউড়া উপজেলার সকল মন্দির কমিটির নেতৃবৃন্দকে নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ। ৩০ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুবিধাজনক সময়ে প্রত্যেক মন্দিরে প্রতিবাদ সভা। ২ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, জনপ্রশাসন উপদেষ্টা, ধর্ম উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান। ৩ সেপ্টেম্বর আধাবেলা দোকান বন্ধ। ৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় সকল মন্দির ও হিন্দু বাড়িতে একযোগে শঙ্খ বাজানো। এছাড়া সুশীল সমাজ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখা ও মন্দিরে মন্দিরে কালো পতাকা উত্তোলন চলমান থাকবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাধানগর কলেজ পাড়ার আনিসুর রহমান ভূইয়া নামে এক ব্যক্তি উচ্চ আদালতে দায়ের করা একটি রিট পিটিশনের আলোকে খাস জমি ও ব্যক্তি মালিকানা জমি চিহ্নিত করে উপজেলা প্রশাসন। ২০ আগস্ট বুধবার দুপুরে জমি পরিমাপ করে শ্মশাণের ভিতর লাল পতাকা টানানো হলে এতে কমিটির পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এটি সরকারের ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত জমি। সরকার শুধু নিজেদের জায়গার পরিমাপ করবে। সরকার এ জায়গা নিতে আসেনি। এ অবস্থায় পরিমাপ কার্যক্রম চলতে থাকে। এক পর্যায়ে আনিসুর রহমানের লোকজনের পক্ষ থেকে বলাবলি শুরু হয় খাস খতিয়ানের বাইরের জায়গাটুকু তারা দখলে নিবে। এরই মধ্যে তারা জায়গা দখলের জন্য টিন, বাঁশ নিয়ে আসে। কমিটির মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ এসে বাধা দেয়। তবে ২৭ আগস্ট ওই পক্ষটি শ্মশাণের ভিতরের জায়গার বদলে বাইরে জায়গা দখল করে ফেলে। এমনকি খাস জমি হিসেবে চিহ্নিত জায়গায়ও বেড়া দিয়ে দেয়। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দেয়।
অবশ্য সেবাশ্রমের সভাপতি হিরালাল সাহা ও পুজারি আশীষ ব্রহ্মচারি জানান, জায়গা নিয়ে মামলা চলমান। আদালতের আদেশের একটি মীমাংসিত বিষয় নিয়ে প্রতিপক্ষকে জায়গা দখলের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
ইউএনও অতীশ দর্শী চাকমা বলেন, ‘উচ্চ আদালতের একটি আদেশের উপর ভিত্তি করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আসা নির্দেশে খাস জমি চিহ্নিত করা হয়। পরিমাপ করে দেখা যায় শ্মশাণের ভিতরে কিছু খাস জমি আছে। চাইলে শ্মশাণ কর্তৃপক্ষ এ জায়গার জন্য আবেদন করা বা অন্য কোনো উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে কাউকে কোনো জায়গা বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি।’